ঢাকা শনিবার, ০৭ জুন, ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
amaderkhobor24.com
দাম বেড়েছে

গরু কোরবানি কমেছে

আমাদের খবর ২৪

প্রকাশিত: জুন ৪, ২০২৫, ১১:২৯ এএম

গরু কোরবানি কমেছে

বছর বছর গরুর দাম বাড়ছে। অন্যদিকে কমছে গরু ও মহিষ কোরবানির সংখ্যা।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সাল মিলিয়ে গড়ে বছরে ৫৪ লাখের কিছু বেশি গরু-মহিষ কোরবানি হয়েছে। ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে গড়ে ৪৭ লাখ ৩৩ হাজার গরু-মহিষ কোরবানি হয়েছে। অর্থাৎ গরু-মহিষ কোরবানি কমেছে গড়ে ১৪ শতাংশ। উল্লেখ্য, গরুই বেশি কোরবানি হয়। মহিষের সংখ্যা থাকে হাজার পঞ্চাশেক।

বাজার বিশ্লেষক ও কোরবানিদাতাদের কেউ কেউ বলছেন, গরুর দাম এতটাই বেড়েছে যে অনেকে কোরবানি দিতে পারছেন না। কেউ কেউ অতীতে একটি গরু কোরবানি দিতেন, এখন দেন ভাগে। কেউ কেউ গরুর বদলে ছাগল কোরবানি দিচ্ছেন। ভাগে গরু কোরবানি দেওয়ার চেয়ে ছাগলে খরচ কম।

সার্বিকভাবেও কোরবানি কমেছে। ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে বছরে গড়ে কোরবানি হয়েছে ১ কোটি ২ লাখ ১১ হাজার গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও অন্যান্য প্রাণী। ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে গড়ে কোরবানি হয়েছে ১ কোটি ১ লাখ ৩৫ হাজার প্রাণি, যা আগের চেয়ে দুই লাখ কম। যদিও বছর বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ফলে কোরবানি বাড়ার কথা।

কেন কমল, সেই ব্যাখ্যায় অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যায়, মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্তের অনেকে কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছে। একে তো গরু-ছাগলের দাম চড়া, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতিতে তাঁদের খরচ বেড়েছে। আয়বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ফলে একটি শ্রেণি বেশি খরচ করতে পারছে। সীমিত আয়ের মানুষেরা বিপাকে রয়েছেন।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে মূল্যস্ফীতির চাপ ছিল। অন্যদিকে গরু ও মহিষের দামও বেড়েছে। ফলে কোরবানি দেওয়া অনেকের সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রতিবছরই বলে থাকে, কোরবানিযোগ্য প্রাণীর সংখ্যা চাহিদার তুলনায় উদ্বৃত্ত। তারা ২০২৩ সালে ২১ লাখের বেশি এবং ২০২৪ সালে প্রায় ২৩ লাখ কোরবানিযোগ্য প্রাণী উদ্বৃত্ত থাকার তথ্য দেয়।

এ বছরও গত ৪ মে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, এবার ঈদুল আজহায় প্রায় ২১ লাখ কোরবানিযোগ্য প্রাণী উদ্বৃত্ত থাকবে। চাহিদার চেয়ে বেশি গবাদিপশু থাকায় এ বছর কোরবানির ঈদের জন্য পশু আমদানি করা হবে না।

কিন্তু বাজারের দামের সঙ্গে এই হিসাব মেলে না। বাজারের সাধারণ সূত্র, সরবরাহ যখন বেশি থাকে, তখন দাম কমে।

যেমন আলু। গত বছরের শেষের দিকে আলুর কেজি ৮০ টাকায় উঠেছিল। কারণ, বাজারে সরবরাহ কম ছিল। নতুন মৌসুমে ভালো ফলন হয়েছে। ফলে দাম নেমেছে কেজিপ্রতি ২৫ টাকায়। এখন কৃষক যে দাম পাচ্ছেন, তাতে খরচই উঠছে না বলে অভিযোগ তাঁদের।

মাংসের বাজারের চিত্র ভিন্ন। বছর বছর দাম বাড়ছে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৮ সালে গরুর প্রতি কেজি মাংসের জাতীয় গড় খুচরা বাজারদর ছিল ৪৩০ টাকা। ২০২৩ সালে তা দাঁড়ায় ৭২৪ টাকা। এখনো গত বছরের (২০২৪) হিসাব প্রকাশ করেনি তারা।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, বাজারে এখন গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

সাধারণত কোরবানিযোগ্য গরুর দাম আরও বেশি হয়। কারণ, এসব গরু বাছাই করে কেনেন ক্রেতারা। গরুগুলো হৃষ্টপুষ্ট ও দেখতে আকর্ষণীয় হয়। ঢাকার গাবতলী গরুর হাটে মঙ্গলবার ছোট আকারের গরু (মণ দুয়েকের মতো মাংস হবে) ৮০ হাজার টাকার আশপাশে বিক্রি হয়েছে। ফলে মাংসের কেজিপ্রতি দর পড়ছে এক হাজার টাকার আশপাশে। ছাগলের দামও চড়া।

সরবরাহ যদি উদ্বৃত্ত হয়, তাহলে দাম কেন বছর বছর বাড়বে, জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, এই সব পরিসংখ্যান বিপজ্জনক। শুধু প্রাণিসম্পদ কেন, অন্যান্য সরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, যাঁরা উৎপাদন বৃদ্ধির দায়িত্বে থাকেন, তাঁরাই যদি উৎপাদনের হিসাব তৈরি করেন, সেটা হবে স্বার্থের সংঘাত। তৃতীয় কোনো পক্ষ দিয়ে পরিসংখ্যান তৈরি করা উচিত।

অধ্যাপক সেলিম শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য। শ্বেতপত্রে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তৈরি করা পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, তারা নিজেদের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কোরবানিযোগ্য প্রাণীর সংখ্যা হিসাব করে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে তথ্য–উপাত্ত পাঠানো হয়। একেকটি উপজেলায় আট থেকে নয়জন কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকেন।

প্রাণিসম্পদের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা কর্মীরা তথ্য সংগ্রহ করেন। খামার তাঁদের নিবন্ধিত থাকে। ফলে তাঁরা যে হিসাব দেন, সেটা সঠিক।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) এ বি এম খালেদুজ্জামান বলেন, মাঠপর্যায় থেকে যে তথ্য আসে, তার ভিত্তিতেই কোরবানিযোগ্য প্রাণীর হিসাব তৈরি করা হয়।

কোরবানিযোগ্য প্রাণীর সংখ্যা আর কেউ হিসাব করে না। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে হিসাব হয়। সেসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিসংখ্যান ব্যুরোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার হিসাবের পার্থক্য ব্যাপক। যেমন বিবিএসের হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদিত হয়েছে ১৮ লাখ ৪৩ হাজার টন। একই সময়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, উৎপাদন হয়েছে ২৫ লাখ টনের বেশি।

ব্যাপক ফারাক হয় বলে চালসহ প্রধান প্রধান কয়েকটি ফসলের হিসাব বিবিএস ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মিলে করে।

বাংলাদেশে গরুর মাংসের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে ২০১৪ সাল থেকে। ওই বছর ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসে এবং বাংলাদেশে গরু রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। সেই নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল আছে।

নিষেধাজ্ঞার আগে ভারত থেকে ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে ২০ থেকে ২২ লাখ গরু-ছাগল বৈধ-অবৈধ পথে বাংলাদেশে আসত। এ ছাড়া অন্যান্য সময় ধরলে বছরে ভারত থেকে ৩০ লাখের মতো গরু-ছাগল আসত।

এত বিশালসংখ্যক গরু-ছাগল আমদানি বন্ধ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলতে শুরু করে সরকার। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, সে বছর বাংলাদেশ মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলা হলেও ২০১৪ সালের পর থেকে অব্যাহতভাবে গরুর মাংসের দাম বেড়ে চলেছে।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ হওয়ার পর মাংসের ঘাটতি তৈরি হয়। সেই ঘাটতি যথাযথভাবে পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে দাম বাড়ছে। বর্তমানে গোখাদ্যের বাড়তি দাম, চারণভূমি কমে যাওয়া, সরকারের পর্যাপ্ত সহযোগিতার অভাবসহ নানা সংকটে ভুগছে প্রাণিসম্পদ খাত। পাশাপাশি মাংস বেশি হয়, এমন জাতের সম্প্রসারণ খুব একটা হয়নি।

ব্রাহমা জাতের গরু মাংস বেশি দেয়। এই গরুর জাত সম্প্রসারণে প্রকল্প নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রায় ৩১ কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু দেশের দুধের জাতের গরু পালন কমে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলে তারা ব্রাহমা জাতের অনুমোদন দেয়নি। খামারিদের অনেকেই মনে করেন, বেশি মাংস হওয়া জাত ছাড়া উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব নয়। উৎপাদন খরচ না কমলে মাংসের দামও কমবে না। কারণ, মাংস আমদানি নিষিদ্ধ। বাজারে প্রতিযোগিতা কম।

বাজারে গরুর মাংসের কেজি যেমন ৭৫০-৮০০ টাকা, তেমনি ছাগলের মাংসের দামও চড়া। কেজিপ্রতি দর ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা। ফলে স্বল্প আয়ের মানুষ এখন কালেভদ্রে মাংস কিনতে পারে। অবশ্য দেশের মানুষের একটি বড় অংশের হাতে টাকার অভাব নেই। তাদের সমস্যা হয় না।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন অনুষদের ডিন মো. রুহুল আমিন বলেন, চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি থাকলে দাম কমতেই হবে। গরুর মাংস পর্যাপ্ত থাকলে এর দামও বাড়ার কথা নয়, কোরবানিও কমার কথা নয়।

Link copied!